বাংলা চলচ্চিত্রে নদী ও প্রকৃতি

 


 

মানব জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির যেমন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তেমনই সংস্কৃতির সম্পর্কও অবিচ্ছেদ্য। সংস্কৃতি মানুষের জীবনকে বিকশিত করে। সংস্কৃতি মানুষের চিন্তা চেতনাকেও প্রভাবিত করে নানাভাবে। বর্তমান সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বড় একটি মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র হচ্ছে একটা অত্যন্ত জটিল মাধ্যম। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সংগীত, চিত্রকলা, অভিনয়কলা সবকিছুর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল মাধ্যম। তবে এই কথাও স্বীকার করতে হবে যে চলচ্চিত্র সব থেকে শক্তিশালী মাধ্যমও বটে। চিত্তবিনোদন ছাড়াও চলচ্চিত্র সমাজ গঠনে, শিক্ষা বিস্তারে ও গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বলা হয়ে থাকে, অসংখ্য গ্রন্থ যে শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারে না একটি চলচ্চিত্র তা সহজে পারে, যদি তার বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলী উঁচু মাপের হয়। চলচ্চিত্রে মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে, সেইসাথে মানুষের চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশও স্থান পায় মানুষের গল্পকে ঘিরেই। 


আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের ইতিহাসের শুরু থেকেই চলচ্চিত্রে বাংলার প্রকৃতি আলাদা দ্যোতনা নিয়ে হাজির হয়েছে। বারবার দর্শকের চোখে দিয়েছে মুগ্ধতার পরশ, সেই সাথে চিরকালীন ঐতিহ্যে বাংলার প্রকৃতিকে ধারণ করেছে বাংলা চলচ্চিত্র।  
যুগে যুগে চলচ্চিত্রে বাংলার প্রকৃতি ধরা পড়েছে নানাভাবে। বাংলার প্রকৃতি মূলত নদীকে প্রাধান্য করেই তাই চলচ্চিত্রেও এই ব্যাপারটি উঠে এসেছে বারবার। ঠিক কতটি বাংলা চলচ্চিত্রে এ যাবত শুটিং স্পট হিসেবে নদী ব্যবহৃত হয়েছে, তার পরিসংখ্যান নেই। তবে সিনেমার নামের মধ্যে ‘নদী’ রয়েছে এমন ছবি রয়েছে বেশ কটি।


শীতলক্ষ্যা নদীকে নিয়ে ১৯৫১ সালে নির্মিত ‘দ্য রিভার’ চলচ্চিত্র এক্ষেত্রে একটি বড় উদাহরণ। ফরাসি ঔপন্যাসিক রুমার গডেন এর ‘দ্য রিভার’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন আরেক ফরাসি পরিচালক জঁ রনোয়ার। এই চলচ্চিত্রে সেই সময়ের শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের মানুষের জীবন এবং প্রকৃতি চিত্রায়িত হয়েছে। বাংলার নদী এবং নদী পাড়ের জীবন নিয়ে বাংলা ভাষায়ও নির্মিত হয়েছে অসংখ্যা চলচ্চিত্র। মোটাদাগে কয়েকটি সিনেমার কথা বলা যায়। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’- ভারত বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এ ছবিটির শুটিংয়ে ব্যবহৃত হয়েছে পদ্মা নদী। মাণিক বন্ধ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস’ পদ্মা নদীর মাঝি’ অবলম্বনেই এই সিনেমা নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর পর ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রটিও একটি নদী কেন্দ্রিক সিনেমা। 

বিদ্রোহী পদ্মা নামের চলচ্চিত্রটি আশকার ইবনে শাইখের উপন্যাস অবলম্বনে ২০০৬ সালে বাদল খন্দকার নির্মাণ করেন। পদ্মা নদীর চর নিয়ে শোষক ও শোষিতের লড়াইয়ের আখ্যান হলেও এ সিনেমায় ফুটে উঠেছে প্রমত্তা পদ্মার রূপ বৈচিত্র্য। পদ্মা নদীকে নিয়ে আরও একটি চলচ্চিত্রের কথা উল্লেখ করা যায়। রাশিদ পলাশ নির্মিত সিনেমা ‘পদ্মাপুরাণ’। পদ্মার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে শুরু করেছে নদী পাড়ের মানুষের জীবন। এ পরিবর্তনগুলোই ‘পদ্মাপুরাণ’ সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে সুন্দরভাবে। 

এছাড়াও তৌকির আহমেদের পরিচালনায় ‘হালদা’ নদীতে নির্মিত হয়েছে নাট্য চলচ্চিত্র ‘হালদা’।  এছাড়াও কীর্তনখোলা নামে আরেকটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ২০০০ সালে। তবে নদী ও বাংলার গ্রামীণ নিয়ে নির্মিত বহুল প্রশংসিত চলচ্চিত্র হচ্ছে চিত্রা নদীর পারে। তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে দেশভাগের কাহিনী বর্ণিত হলেও এখানে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নির্মল রূপ চিত্রায়িত হয়েছে অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিমায়। 


সাম্প্রতিক সময়ের আরেকটি সিনেমা বেশ আলোড়ন তুলেছে দর্শক মহলে। ‘সাঁতাও’ নামের এই চলচ্চিত্রটিতে তিস্তা নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবন প্রকৃতির বর্ণনা পাওয়া যায়। খন্দকার সুমন পরিচালিত এ চলচ্চিত্রে অন্যতম একটি উপাদান প্রকৃতি ও এর বৈচিত্র্য। সেই সঙ্গে আবহাওয়ার পালাবদল ছিল গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সিনেমাজুড়েই আছে নদীপাড়ে মানুষের জীবনযাপন, নানা রকম পশু-পাখির চলাচল। নির্মাতা বন্যা, খরা, মাঠের ফসল এবং ঋতু পরিবর্তনের প্রতিটি বিষয় ক্যামেরাবন্দি করেছেন।


নদী কেন্দ্রিক সিনেমা ছাড়াও বাংলার প্রকৃতির অন্য রূপও উঠে এসেছে বিভিন্ন চলচ্চিত্রে। এক্ষেত্রে প্রথম যে চলচ্চিত্রের কথা বলতে হয় সেটি হলো ‘দুখাই’। এই চলচ্চিত্রটিকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাস্তব বর্ণনা। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এক সাইক্লোন আছড়ে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভোলায়। এমনই মর্মান্তিক কাহিনী নিয়ে, ১৯৯৭ সালে নির্মাতা মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনায় নির্মিত হয় অন্যতম চলচ্চিত্র ‘দুখাই’। এতে দেখানো হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-সংগ্রামের নানা চিত্র। পরিচালক এই চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অত্যন্ত নিখুঁত ও বাস্তবতার আদলে পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের দৃশ্যগুলো অনবদ্য। বাংলাদেশের সিনেমায় এ ধরনের বাস্তবসম্মত দৃশ্য অনেকটাই বিরল। 


বাংলার প্রকৃতির চিরায়ত রূপ ফুটে উঠেছে এমন আরেকটি চলচ্চিত্র হলো প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ও নির্মাতা জহির রায়হানের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রটি। এখানে বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতি ও এর মোহময়তা ফুটে উঠেছে। বিল, শাপলাসহ নানান প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ ব্যক্ত করা হয়েছে এই সিনেমায়। একই ধাঁচের আরেকটি চলচ্চিত্রও বাংলার প্রকৃতিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ছবিটির নাম ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’। এই সিনেমায় বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের প্রকৃতি ও পরিবেশের চিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে। 


বাংলার নির্মল প্রকৃতি স্যালুলয়েডে সুন্দর চিত্রায়িত করেছেন নির্মাতা ও সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তার নির্মিত শ্রাবণ মেঘের দিন কিংবা ঘেঁটু পুত্র কমলা সিনেমায় বাংলার হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দারুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। এছাড়াও তার নির্মিত শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রেও বাংলা শ্যামল রূপ প্রকাশ পেয়েছে। 


বর্তমান সময়ে নির্মিত ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সিনেমাটিতেও হাওর এবং হাওরের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য প্রকাশ পেয়েছে চমৎকার ভঙ্গিমায়। 


বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশ চলচ্চিত্রে নানাভাবেই এসেছে। অনেক চলচ্চিত্র আছে যেগুলোতে বাংলার রূপ নীলিমা মানুষের চোখকে প্রশান্তি দিয়েছে। এমন কিছু চলচ্চিত্র হলো – ময়নামতি, গেরিলা, নদী ও নারী, বক, সূর্যস্নান, সারেং বোউ, বেহুলা, মেঘের পরে মেঘ, নদী জন, দারুচিনি দ্বীপ, উত্তরের সুর, লালসালু, মাটির ময়না, লালন, মনের মানুষ, ধীরে বহে মেঘনা, কাজলরেখা। 


বিশ্বের অন্যান্য দেশে চলচ্চিত্র সেই সব দেশের মানুষের ঐতিহ্য-সংগ্রাম, চিন্তাচেতনাকে সমৃদ্ধ করে উন্নত সংস্কৃতি চেতনা নির্মাণে সহায়তা করেছে। আমাদের ছায়াছবিও আমাদের জনপদের জলবায়ু, প্রকৃতি, পরিবেশ, কৃষিকাজ কৌশল, যুদ্ধবিগ্রহ, উৎসব, এবং প্রকৃতিকে ঘিরেই নির্মিত হয়েছে বেশি। তবে বর্তমান আধুনিক সময়ে এসে অনেক কিছুই পরিবর্তন ঘটছে। তবুও আমাদের চলচ্চিত্র এবং আমাদের প্রকৃতি সুন্দর থাকুক যে যার মতো করে।


Previous Post Next Post