কুরচি তোমার লাগি


দূর থেকে দেখে মনে হবে ধবধবে সাদা পাতায় ঢাকা একটা গাছ দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি আসলেই মিষ্টি একটা মিহি ঘ্রাণ টের পাওয়া যাবে। এই ফুলের নাম কুরচি। বাংলায় আরও নাম রয়েছে শুভ্র সতেজ এই ফুলের। কুরচি, গিরিমল্লিকা, কুটজ, ইন্দ্রযব, ইন্দ্রজৌ, বৎসক, কলিঙ্গ, প্রাবৃষ্য, শত্রুপাদপ, সংগ্রাহী, পান্ডুরদ্রুম, মহাগন্ধ নানা নামেই ডাকা হয় একে। ইংরেজি নাম: Bitter Oleander, Easter Tree, Connessi Bark, sentery Rose Bay, Tellicherry Bark বৈজ্ঞানিক নাম : Holarrhena antidysenterica (Syn. H.pubescens)

মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের স্থানীয় প্রজাতি এটি। শুভ্রতা ও সুগন্ধিতে এই ফুল অনন্য। ক্ষুদ্র আকৃতির পত্রমোচী এই বৃক্ষের উচ্চতা ৬-৭ মিটার হয়ে থাকে। কাণ্ড সরল, বাকল অমসৃণ ও হালকা ধূসর রঙের। উপরের দিকে অজস্র ঊর্ধ্বমুখী শাখায় এলোমেলো। পাতা বেশ বড়, ১২-২০ সেমি লম্বা, ভল্লাকার বা লম্ব-ডিম্বাকারমসৃণ এবং উভয়ের বিপরীত দিকে সমভাবে বিন্যস্ত থাকে। শীতকালে এর সব পাতা ঝরে পড়ে।

ফাল্গুনের শেষভাগে দু-এক স্তবক কচি পাতার সঙ্গে ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। কুরচি মঞ্জরিতে ফুলসংখ্যা কম হলেও বিক্ষিপ্ত মঞ্জরির সংখ্যা অজস্র। বসন্তের শেষে সমস্ত গাছে ছোট ছোট থোকার সাদা ফুলে ভরে ওঠে এবং শরৎ পর্যন্ত কিছু গাছে ফুল দেখা যায়। ২-৪ সেমি চওড়া ফুলের ২-৩ সেমি লম্বা নলের আগায় ৫ পাপড়ি, সুগন্ধি। ফুলের নিচের অংশ নলাকৃতির, ওপরটা মুক্ত পাপড়িতে ছড়ানো। মুক্ত অংশটি আবার কিছুটা বাঁকানো। ফুলের বৃত্তাংশও পাঁচটি। ফল সজোড়, সরু, ২০-৩৫ সেমি*৫-৬ মিমি। বীজ ১-১.৩ সেমি লম্বা, রোমে জড়ানো। বীজ ও শিকড় থেকে গজান চারার মাধ্যমে চাষ।

 “কুরচি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা/ যে ভ্রমর, শুনি নাকি তারে কবি করেছে ভর্ৎসনা/ আমি সেই ভ্রমরের দলে। তুমি আভিজাত্যহীনা/ নামের গৌরবহারা; শ্বেতভুজা ভারতীয় বীণা” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ফুলকে নিয়ে বিরাট এক কবিতা লিখেছেন। উপরের কয়েকটি লাইন সেই কবিতারই অংশবিশেষ। এছাড়াও মহাকবি কালিদাস কুরচির রূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন তার মেঘদূত কাব্যে। 

শুধু কবিদের মুগ্ধ করাই কুরচির কাজ নয়। এই গাছের রয়েছে অনেক ভেষজ গুণ। কুরচির ছালে রয়েছে হোলাডিনেমাইন, কুরচাসিন, কোনিমাইন, হোলডিসিন আর সিটেস্টেরল নামক অ্যালকালয়েড। ফুল, বাকল ও ফল থেকে মেলে আমাশয়ের, ডায়রিয়া ও রক্তপিত্তের ঔষধ। তাছাড়া ফুল রক্তদোষে, পাতা বাত ও ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসে, বীজ অর্শ্ব ও একজিমায় উপকারী। হাঁপানি রোগে শিকড়ের রস দারুণ উপকারী। কোষ্ঠকাঠিন্য, প্রস্রাবের জ্বালা-পোড়া, কৃমিরোগ ও মুখের ঘায়ে এর শিকড়, পাতা ও বাকল খুব কার্যকর! আমাদের দেশে সর্পদংশন এবং বিছার কামড়েও এ গাছের বাকল ব্যবহার করা হতো। আসামে কুরচি কাঠের কবজ ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে। তাছাড়া এর নরম কাঠ থেকে পুতুল ও খেলনা তৈরি হয়। 

কুরচি গাছ পাওয়া যায় সারাবাংলাদেশেই। ভারত বর্ষের স্থানীয় প্রজাতি হওয়ায় এই অঞ্চলের আবহাওয়ায় কুরচি গাছ বেশ সহজেই বেড়ে ওঠে। কিন্তু প্রকৃতির প্রতি মানুষের লোভের বলি হচ্ছে এই গাছ। ক্রমশ কমে যাচ্ছে ভেষজ গুণ সমৃদ্ধ এই গাছটির। যেখানে অন্য দেশের চেরি ফুলের প্রতি আমাদের মুগ্ধতার শেষ নেই, সেখানে রূপে গুণে অনেক বেশি আকর্ষণীয় এই গাছটি অনাদরে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রকৃতি থেকে। এখনই এই গাছটি সংরক্ষণ এবং ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু না হলে হয়তো একসময় শুধু ছবিতেই দেখা যাবে কুরচি ফুলের সৌন্দর্য। তাই মানুষকে সচেতন করতে এবং কুরচি গাছ রক্ষা করতে চাইলে রাস্তার পাশে প্রচুর পরিমাণে এই গাছ রোপণ করতে হবে। এতে একটি প্রজাতি রক্ষা পাবার পাশাপাশি আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও বাড়বে বৈ কমবে না।  

 

Previous Post Next Post