ইদানীং একটা শব্দের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। যে কোন আন্দোলনে শব্দটা যেন একটা অস্ত্র হয়ে ওঠে। শব্দটা হচ্ছে ‘বয়কট’। শব্দটার আক্ষরিক মানে হচ্ছে, একঘরে করে রাখা বা বর্জন করা। বয়কট শব্দ শুনেনি এই যুগে এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিন্তু কিভাবে এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সেটি হয়তো সবার জানা নেই। অন্যান্য ইংরেজি শব্দের মতো বয়কট শব্দের উৎপত্তি হয়নি। এর পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। রয়েছে এক অদ্ভুত রহস্যও। চলুন জেনে নেওয়া যাক বয়কট শব্দের রহস্য সম্পর্কে।
বয়কট শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে হলে ইতিহাসের পাতায় ১৮৮০ সালে ফিরে যেতে হবে। বয়কট নামের একজন মানুষের সাথে পরিচয় হওয়া যাক আগে। ঊনিবিংশ শতকের শেষভাগে আইরিশ এক জমিদার ছিলেন তৃতীয় আর্ল আরনে জন ক্রিকটন নামে। লর্ড আরনে-এর একজন এজেন্ট ছিলেন চার্লস কানিংহাম বয়কট। ব্যক্তিজীবনে চার্লস বয়কট ছিলেন খুবই জেদি এবং একগুঁয়ে প্রকৃতির।
আয়ারল্যান্ডের মায়ো কাউন্টির জমিদার লর্ড আরনে-এর বিশাল জমিদারির এক অংশ দেখাশোনা করার ভার ছিল চার্লস বয়কট এর উপর। ১৮৮০ সালে খরার কারণে আয়ারল্যান্ডে শস্য উৎপাদন মারাত্মক রকমের ব্যাহত হয়। ফসল উৎপাদন এত বেশি কমে যায় যে মানুষের জীবন ধারণই অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। এমন সময় জমিদারের খাজনার সময় চলে আসে। সাধারণ কৃষক প্রজাদের মাথায় হাত। যেখানে নিজেদের খাবার জোগানই হয়নি সেখানে জমিদারের খাজনা পরিশোধ করবেন কিভাবে! তবে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন লর্ড আরনে। তিনি প্রজাদের খাজনা ১০ শতাংশ ছাড় দিলেন। তবেও এতেও আসলে কোন সমাধান হলো না। এরপরও প্রজাদের খাজনা দেবার অবস্থা হলো না।
গরিব প্রজারা আন্দোলন করে বসলো খাজনা কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কমাতে হবে। এবার লর্ড আরনে প্রজাদের এই দাবি মানলেন না। বিদ্রোহী প্রজাদেরকে দমন করার জন্য তার বিশ্বস্ত প্রতিনিধি চার্লস বয়কটকে পাঠালেন। চার্লস বয়কট একগুঁয়ে প্রকৃতির হওয়ায় প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা দেখেও তার মন এতটুকু গললো না। তার মনে কেবলই পুরো খাজনা আদায়ের অভিপ্রায়। ধীরে ধীরে তার অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো।
একে তো দরিদ্র তার উপর সেবছর ফসলও নেই; এরমধ্যে জমিদারের প্রতিনিধির এমন অত্যাচার, কৃষকদের যেন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কৃষকদের এমন অবস্থায় ত্রাতা হয়ে এলেন চার্লস স্টুয়ার্স পারনেল নামের একজন। তিনি ছিলেন আইরিশ ল্যান্ড লীগের একজন সদস্য। তিনি সাধারণ মানুষকে বুদ্ধি দিলেন অত্যাচারী চার্লস বয়কটকে শিক্ষা দিতে হবে, তবে তা অবশ্যই শান্তিপূর্ণ উপায়ে। সেই পদ্ধতিও বাতলে দিলেন তিনি। অত্যাচারীদের সামাজিকভাবে বহিষ্কার করা হবে। সোজা কথায় একঘরে করে রাখা হবে। কেউ তার সাথে কথা পর্যন্ত বলবে না।
পারনেলের কথা স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে গেল। তার কথামত সবাই চার্লস বয়কটতে অবজ্ঞা করতে শুরু করলো। শ্রমিকরা জমির কাজ ছেড়ে দিলো। ব্যবসায়ীরা বয়কটের কাছে পণ্য বেচা বন্ধ করলো। পারতপক্ষে কেউ তার দিকে ফিরেও চাইতো না। তার চিঠি পৌঁছে দিত না কোন ডাকপিয়ন। এমনকি বয়কটের বাড়ির কাজের লোকেরাও চলে গেলো কাজ ছেড়ে দিয়ে। সবদিক থেকে এভাবে চাপ সৃষ্টি হওয়ায় বয়কট বেশ ঝামেলাতেই পড়ে গেলো। আর্থিক দিকেও তার অবস্থা তখন বেশ নাজেহাল।
তবে সেও কম যাবার পাত্র নয়। বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসলো জমিতে কাজ করার জন্য। তাদের নিরাপত্তার জন্য হাজার খানেক সশস্ত্র নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ করলো চার্লস বয়কট। এই কারণে স্থানীয় কৃষকরা তার উপর আরও চটে গেলো।
তবে এইক্ষেত্রে পারনেল সবাইকে শান্ত থাকতে বললেন। সংঘাতে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন চালিয়ে গেলেন। এদিকে বাইরে থেকে আনা এতগুলো লোকের খরচ সামলাতে বয়কটের অবস্থা একেবারেই নাজেহাল হয়ে উঠলো। পরের বছরের ফসলের খরচ দিয়ে এদের বেতন ভাতাই হলো না ঠিক মতো। আর্থিক দিক থেকে একেবারে ভেঙে গেলো চার্লস বয়কট।
এদিকে কৃষকরা তাকে সামাজিকভাবে বহিষ্কার করেই রাখলো। তাকে এভাবে একঘরে করে রাখার এই কাহিনী তখনকার সব পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হতে থাকলো। ভিন্নধর্মী এক আন্দোলনে বেশ সাড়া পড়ে গেলো সমগ্র ব্রিটেনে। কোন অন্যায় অবিচার মেনে না নিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সামাজিকভাবে বহিষ্কার করে আন্দোলন এর ধরণ শুরু হলো সারা বিশ্বেই। আর এই আন্দোলনকে ডাকা হতে লাগলো ‘বয়কট’ নামে। এভাবেই বয়কট শব্দটি ইংরেজি অভিধানে একদিন স্থান করে নিলো।